অনুবাদ: জুবায়ের রহমান
গত সপ্তাহের শেষের দিকে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। যেখানে ৯ জন শিশু সহ প্রায় ৭৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ৭০ জনেরও বেশি নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিখোঁজদের কেউই এখন আর জীবিত নেই।
এমন দুঃখজনক ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সম্প্রতি কয়েক মাসে নৌকা করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে চেষ্টাকারীর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের মতে, জানুয়ারি থেকে ১ লা অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত ১৭৮৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে নৌকায় করে পালিয়েছে। তারপর থেকে, প্রায় ৩১০০ জন এমন যাত্রা শুরু করেছে। যা পূর্বের চেয়ে প্রায় ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ১ লা অক্টোবর পর্যন্ত ২৮০ জন সহ প্রায় ৪৯০ জন রোহিঙ্গা মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে বলে জানা গেছে।
মালয়েশিয়া এবং সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করলে তারা ব্যর্থ হয়। যার ফলে অনেক রোহিঙ্গা সমুদ্রে আটকা পড়েছে। তবে এতে নিপীড়ন-শোষণ, পাচার এবং এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কেন এত রোহিঙ্গা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে? এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট কে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত?
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় আলোকে আমরা (দুই অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষাবিদ এবং ছয়জন বেনামি রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট) “পুশ ফ্যাক্টর” বর্ণনা করেছি। যা ক্যাম্পে কমিউনিটি-ভিত্তিক গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে, যা অনেক লোককে নৌকায় চড়ার চেষ্টা করতে বাধ্য করছে নিরাপত্তা পৌঁছাতে।
প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা নিয়ে বসবাস
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে তাড়া খেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। যারা মিয়ানমারের সামরিক অভিযান থেকে বেঁচে গিয়েছিল। সেসময় আনুমানিক প্রায় ৭৮০০ জন থেকে ২৪০০০ জন নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়েছে। জাতিসংঘ এটিকে জাতিগত নির্মূল ও গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে। তবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসার আগেও রোহিঙ্গারা কয়েক দশক ধরে বৈষম্য, নাগরিকত্ব অস্বীকার, স্কুল ও কাজ থেকে বাদ, চলাচলের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ এবং কর্তৃপক্ষের সহিংসতার শিকার হয়েছিল।
তবে সামরিক বাহিনীর তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে আসার পরও তারা একই ধরনের সমস্যায় পতিত হয়েছে।
২০১৯ সালে আমরা শিক্ষক, মা, ধর্মীয় নেতা, আধ্যাত্মিক নিরাময়কারী, যুবক এবং কর্মীসহ কক্সবাজারে বসবাসকারী ২৭ জন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিশেষজ্ঞদের সাথে মাঠ সাক্ষাৎকার পরিচালনা করেছি। আমরা জানতে চেয়েছিলাম কীভাবে রোহিঙ্গা জনগণ গণহত্যা এবং বাস্তুচ্যুতির মতো বিষয়গুলোর মানসিক প্রভাব তারা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারে, কতটুকু বোঝে এবং কি বর্ণনা করে।
এই বোঝাপড়াটি তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বেশিরভাগ মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলি পশ্চিমা পরিভাষাগুলির উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। যেমন “বিষণ্নতা”, “উদ্বেগ” বা “স্ট্রেস”। কিন্তু এগুলো হয়ত রোহিঙ্গাদের অভিজ্ঞতার সাথে ঠিকভাবে খাপ খায় না। পরিবর্তে, আমরা দেখতে পেলাম ইংরেজি শব্দ “টেনশন” (রোহিঙ্গা ভাষায়, সিনটা) অনেক শরণার্থী ব্যবহার করেছে, যা উদ্বেগ, উদ্বেগ এবং উদ্বেগের অনুভূতি প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রহীন হওয়ার অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে।
দুই অজ্ঞাতনামা কিশোরী রোহিঙ্গা নারী আমাদের কাছে এটি বর্ণনা করেছেন:
কিছু করার সুযোগ নেই, আমরা যা করি তা হল ভিতরে থাকা।
টেনশন হল ক্ষতি। আমরা জমি, সন্তান, স্বামী হারিয়েছি, তাই আমরা টেনশন অনুভব করছি।
টেনশন হল ঘাড় ব্যথা। টেনশন হল গলা, কাঁধ এবং মাথা ব্যথা।
আমরা ইন্টারভিউ পরিচালনা করার পরে নতুন করে আমরা “টেনশন” এর একটি সচিত্র মডেল তৈরি করেছি। কারণ টেনশন শব্দটি রোহিঙ্গাদের একটি মৌখিক ভাষা। মডেলটি (নিচে) দেখিয়েছে যে কীভাবে “সুযোগ-কম” – কাজ, শিক্ষা বা চলাচলের স্বাধীনতার অভাব থেকে – তাদের মনো-উত্তেজনার কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠে। আর এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমরা পেয়েছিলাম যে সুযোগের অভাবে তারা খুব বেশি চিন্তিত হয়ে উঠে। পাশাপাশি শরীর ব্যথা, পরিবারে, পরিবারের মধ্যে এবং বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সাথে দ্বন্দ্বের মতো বিষয়গুলো উঠে আসে।
কেন যেন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে
২০১৯ সাল থেকে তাদের টেনশনের উৎসগুলো কীভাবে তাদের আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে সেটি আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন ৬ জন রোহিঙ্গা কর্মী। মূলত তারাই আমাদের গবেষণাটি করতে সহযোগিতা করেছিল। তাদের সম্প্রদায়ের অনেকের মতে, তারা ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের দ্বারা নির্বিচারে গ্রেফতার, বানোয়াট আইনি মামলা এবং কারাবাসের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে।
অন্ধকারে সশস্ত্র দল ক্যাম্পে ঘুরে বেড়ায়। প্রায় সময়ই পরিবারের কাছ থেকে অপহরণ করে এবং মুক্তিপণ দাবি করে। রোহিঙ্গাদের বাড়িতে তারা মানুষকে হুমকি দেয়, মাদক পাচার করে এবং যে কেউ কোনো প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে তাকে হত্যা করা হয়। নারী ও মেয়েরা হলো লাঞ্ছনা ও পাচারের লক্ষ্যবস্তু।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো খোলা বাতাসে কারাগারের মতো। যার চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আগুন চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে শরণার্থীরা আটকা পড়ে। যা এখানকার প্রায়শই ঘটনা। গত জানুয়ারিতে একটি বিশাল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ঐ ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ৮০০টি আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায় এবং ৭০০০ রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়ে। এছাড়াও সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা মর্টার শেল দ্বারা নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে একটি। সহায়তা ছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে এই চাপের কারণগুলোকে মোকাবেলা করতে পারে না। এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়া এবং আঞ্চলিক অংশীদারদের কি করা উচিত?
এই সমস্যার একটি টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করতে পারে এবং করা উচিত? আঞ্চলিক সহযোগী হিসেবে অস্ট্রেলিয়া অনেক বড় মানবিক ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে পাচারকারীদের শুধুমাত্র শাস্তি দেওয়া নয়, পাশাপাশি উদ্বাস্তু শরণার্থীদের নৌকা ফেরানোর মাধ্যমে তারা ভূমিকা রাখতে পারে।
মানুষ যখন রোহিঙ্গাদের মতো এই ধরনের ভয়ানক অবস্থার সম্মুখীন হয় তখন তারা যেকোনো উপায়ে এমন স্থান ত্যাগ করতে মরিয়া হতে পারে। অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় সাম্প্রতিক শরণার্থী নৌকার আগমনের প্রমাণ হিসাবে নৌকা ফেরত এবং গ্রেপ্তার জোরপূর্বক অভিবাসনের মূল কারণগুলোকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ তারা “নৌকা বন্ধ” করে না।
রোহিঙ্গা জনগণকে সাহায্য করার পরিবর্তে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং তাদের আঞ্চলিক অংশীদারদের কী করা উচিত তার জন্য এখানে আমাদের সুপারিশ রয়েছে:
১. রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে এবং রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মিয়ানমার জান্তার উপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করুন। যাতে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে পারে।
২. খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, যথাযথ শিক্ষা এবং মনো-সামাজিক সহায়তা সহ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে কর্মরত মানবিক সংস্থাগুলোর অর্থায়নের ঘাটতি পূরণ করুন।
৩. শরণার্থী শিবিরে অবস্থার উন্নতি করতে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য জীবিকার সুযোগ প্রদানের জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ বাড়ান। এতে শরণার্থীদের আইনগতভাবে কাজ করতে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার অনুমতি দেয় এমন নীতিগুলির পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করুন।
৪. তৃতীয় দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের সুযোগকে অগ্রাধিকার দিন। বিশেষ করে যারা ১৯৯০ সাল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পুনর্বাসন আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রয়োজন তাদের জন্য একটি টেকসই সমাধান প্রদান করে। তাদের নিরাপত্তা এবং মর্যাদার সাথে তাদের জীবন পুনর্নির্মাণের সুযোগ প্রদান করে।
(কনভারসেশন থেকে অনুবাদিত। মূল লেখক ১. রুথ ওয়েলস, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ, ইউএনএসডব্লিউ সিডনি। ২. ম্যাক্স উইলিয়াম লুমস, সিনিয়র গবেষক, ইউএনএসডব্লিউ সিডনি।)