34 C
Dhaka
Tuesday, May 14, 2024

কেন প্রত্নতাত্ত্বিকদের গাজার পক্ষে কথা বলতে হবে?

গাজার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সুদূরপ্রসারী সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানসিক প্রভাব রয়েছে। এতে ফিলিস্তিন এবং এর জনগণ ভবিষ্যত সংকটে পড়বে।

Must read

হিলারি মরগান লেথেম

গাজায় যুদ্ধ শুরু পর থেকেই সেখানকার অসংখ্য আর্কাইভ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাদুঘরের পাশাপাশি ২০০ টিরও বেশি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক স্থান ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইসরায়েল সেনাবাহিনী লুটও করেছে। যা পরবর্তীতে ইসরায়েল পার্লামেন্ট নেসেটে প্রদর্শন করা হয়েছে।

গাজার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সুদূরপ্রসারী সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানসিক প্রভাব রয়েছে। এতে ফিলিস্তিন এবং এর জনগণ ভবিষ্যত সংকটে পড়বে।

ফিলিস্তিনের ঐতিহ্য ধ্বংসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের মন থেকে ফিলিস্তিন মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। যার ফলে তারা তাদের ইতিহাস ও ভূমিকে দাবি করতে ব্যর্থ হবে। যদিও এগুলো ইসরায়েলের ইচ্ছাকৃত ধ্বংস কার্যক্রম মাত্র। পোলিশ-ইহুদি আইনজীবী রাফায়েল লেমকিনের মতে, এটি একটি গণহত্যার কৌশল। ফিলিস্তিনিদের এই ঐতিহ্য মুছে ফেলার একমাত্র কারণ হলো ইসরায়েল গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপস্থিতি মুছে ফেলে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করবে এবং সেটির বৈধতা নিশ্চিত করবে।

ইসরায়েল গাজায় যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো লুটপাট করছে, সেখান বিশ্ব কমিউনিটিতে আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে৷ কারণ বাস্তবিক পক্ষে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টির রাজনৈতিক গভীরতা অনেক।

অতীতের কোনো বিষয় নিয়ে যখন দাবি উঠে তখন প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুগত প্রমাণাদি অনেক বড় শক্তি হিসেবে কাজ করে। আক্ষরিক অর্থেই প্রত্নতাত্ত্বিকরা ঐতিহাসিক কোনো বিষয় বর্ণনা করার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে প্রমাণ হিসেবে জাহির করে থাকে। এভাবে একটি ভূখণ্ডের রাজনৈতিক অবস্থানও স্পষ্ট করতে পারে তারা। যা প্রত্নতাত্ত্বিকদের নৈতিক দায়িত্বও বটে।

এই প্রেক্ষাপটে গাজায় যা ঘটছে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থাগুলোর যে অবস্থান তা তাদেরকে স্পষ্টতই বধির করে রেখেছে। ইউরোপে আইরিশ এবং আয়ারল্যান্ড-ভিত্তিক পুরাতাত্ত্বিকগণ এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য ‘ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সমিতির (ইএএ)’ উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। ফলে মার্চের শুরুতে এই সংস্থাটি একটি বিবৃতি দিয়েছেও।

বিবৃতিতে গাজার এই গণহত্যাকে ‘ইসরায়েল/গাজা সংকট’হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ১৯৭২ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশন এর পূর্বের বিবৃতির  ন্যায় একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও এই বিবৃতির মাধ্যমে ঐতিহ্যের আর্থ-সামাজিক মূল্য, অখণ্ডতা বা সত্যতা, স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে বসতি স্থাপনকারী, ঔপনিবেশিক পরিবেশে ঐতিহ্য ধ্বংসের রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলা হয়েছে।

কীভাবে প্রত্নতত্ত্ব ঐতিহ্য নির্মাণে ক্ষমতা ও ইতিহাসের সাথে জড়িত তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। যা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনকও বটে। কারণ এই ডিসিপ্লিনটি সম্পূর্ণ ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

কিছু লোক হয়ত উপনিবেশবাদে প্রত্নতত্ত্বের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন। ইতিহাসবিদ এরিক হবসবাম ও টেরেন্স রেঞ্জার যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে কীভাবে বিংশ শতাব্দীতে ইতিহাস ও ঐতিহ্য মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে তুলে।

প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের মাধ্যমে মানুষ নিজেদের ভূমি ও নিজ গোষ্ঠীর মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। এছাড়াও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা গেলে এটা বোঝা সম্ভব হয় যে কীভাবে আগেকার দিনের মানুষ বসবাস করত। আর যদি ঐতিহ্যকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হয় তাহলে তা মানুষের জন্য নিপীড়নের প্রযুক্তিতে পরিণতি হয়। যার ফলে অন্যের ভূমি দখল ও স্থানচ্যুত করে নিজেদের উপনিবেশ গড়তে চায় তারা।

একই কৌশল গ্রহণ করেছে ইসরায়েলও। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এই বিষয়টি ফুটে উঠে ফিলিস্তিনি-আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ নাদিয়া আবু এল-হাজ এর লিখনিতে। তিনি দেখিয়েছেন যে, ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের ‘আব্রাহামিক পবিত্র ভূমি’তে একটি ঐতিহাসিক জাতি হিসাবে নিজেরা বৈধতা পাওয়ার জন্য কৌশল গ্রহণ করেছে।

প্রত্নতত্ত্ব ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। বিষয়টি শুধু ফিলিস্তিন ইসরায়েল জন্য নয়, সবার জন্য প্রযোজ্য।

মেক্সিকোতে গত ১৫ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে দেখেছি যে, প্রত্নতত্ত্ব এবং নৃতত্ত্ব স্পষ্টভাবে অভিযুক্ত করা হয় ‘ফরজান্দো প্যাট্রিয়ার’বইয়ের সাথে বা জাতিকে জাল করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। মেক্সিকোর দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি পোরফিরিও দিয়াজের শাসনামলে সরকার তার আদিবাসী নাগরিকদের সাথে অন্যদের একত্রিত করতে সংগ্রাম করেছিল যারা স্প্যানিশ উপনিবেশের সময় ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক নির্মূলের শিকার হয়েছিল।

প্রস্তাবনাটি ছিল যাতে একটি মিশ্র জাতি নতুন করে সেখানে একটি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ তৈরি করা। যার মাধ্যমে মেক্সিকান রাজ্যের এবং আদিবাসী মেক্সিকানদের স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংসাবশেষ এবং শৈল্পিক ঐতিহ্যকে সবাই উদ্‌যাপন করতে পারে এবং সবাই সবগুলো নিজেদের দাবি করতে পারে। এটি মেক্সিকোর আদিবাসী সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করলেও এর মাধ্যমে তাদের উচ্ছেদ ও স্থানচ্যুতির দিকে নিয়ে যায়। যেহেতু মেক্সিকান রাজ্যটি সকলের জন্য আদিবাসী ঐতিহ্য দাবি করেছিল, তাই স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত শাসক শ্রেণীর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা হলেন অতীত বিষয়ক পণ্ডিত এবং বিশেষজ্ঞ, যারা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলোকে কেবল ফ্যাশন ইতিহাস নয়, বরং এটিকে নিয়ন্ত্রণ ও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে মানুষকে সচেতন করে থাকে। সেজন্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের গাজা নিয়ে কথা বলতে হবে।

একবার গাজার ঐতিহ্য, লাইব্রেরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় চলে গেলে বলা যেতে পারে যে তারা সেখানে ছিল না। মানুষের স্মৃতি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড উভয় থেকে “তথ্যের বিষয়” মুছে ফেলার সাথে, বৈজ্ঞানিকভাবে প্যালেস্টাইনের উপস্থিতি “প্রমাণ” করা অসম্ভব হবে।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে প্রত্নতত্ত্ব রাজনীতি থেকে অবিচ্ছেদ্য। যা ইতিহাস, জাতি এবং জাতীয় পরিচয় তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কীভাবে ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ মুছে ফেলার মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ কারণে সাংস্কৃতিক গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসেবেও শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।

ইউরোপীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সমিতি (ইএএ) ও অন্যান্য পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থাগুলোর প্রতিবন্ধকতা একটি সীমিত বিবৃতি জারি করার জন্য যা গাজার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়। যা গাজার ঐতিহ্য ধ্বংসের সাথে জাতিগত নির্মূল জটিলতার সমতুল্য এবং প্রত্নতত্ত্বের দায়িত্ব স্বীকার করতে অস্বীকার করা। আমি আশা করি যে ইউরোপ এবং সারা বিশ্বের প্রত্নতাত্ত্বিকদের অব্যাহত চাপ তাদের মন পরিবর্তন করবে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে আমি মনে প্রশ্ন জাগে যে প্রত্নতত্ত্ব কখনও সঠিক কাজটি করতে পারে কিনা? নাকি শুধু নিজের অতীতের সাথে গণনা করতে ইচ্ছুক।

(অনুবাদক: জুবায়ের রহমান, আল জাজিরার থেকে সংগ্রহীত। মূল লেখক: হিলারি মরগান লেথেম, প্রত্নতাত্ত্বিক নৃতত্ববিদ)

- Advertisement -spot_img

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest article